ধরো, কোনো এক বিকেলে অভি, মিতা ও রিনা গাছের ছায়ায় বসে শ্রেণির পড়া নিয়ে আলোচনা করছিল। মিতা, অভিকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা তুমি কি এই গাছের উচ্চতা বলতে পারবে?
অভি বলল: হ্যা, এখুনি আমি গাছে উঠে উচ্চতা মেপে দিচ্ছি।
রিনা সাথে সাথে বলল: গাছে উঠতে পারবে না। গাছে না উঠেই কীভাবে উচ্চতা মাপা যায়, এসো তা বের করার চেষ্টা করি।
মিতা বলল: গাছের একটা ছায়া পড়েছে। দেখো তো ছায়া মেপে গাছের উচ্চতা মাপার কোনো বুদ্ধি বের করা যায় কিনা?
অভি বলল: আসলে ছায়াটি গাছটির সাথে সমকোণে অবস্থান করছে। তাহলে, ছায়ার প্রান্ত বিন্দু থেকে গাছের শীর্ষবিন্দুতে একটি রেখা কল্পনা করলে একটি সমকোণী ত্রিভুজ পাওয়া যাবে। এটি কি কোনো কাজে লাগতে পারে?
রিনা বলল: হ্যা, পিথাগোরাসের উপপাদ্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
মিতা বলল: পিথাগোরাসের উপপাদ্যের সাহায্যে সমকোণী ত্রিভুজের যে কোনো দুই বাহুর দৈর্ঘ্য জানা থাকলে তৃতীয় বাহুর দৈর্ঘ্য বের করা যায়। এখানে গাছের ছায়ার দৈর্ঘ্য অর্থাৎ ভূমি পরিমাপ করা যাবে। কিন্তু অতিভুজের দৈর্ঘ্য মাপতে না পারলে তো আর গাছের উচ্চতা বের করা যাবেনা। সুতরাং আমাদের নিশ্চয় নতুন কোনো সূত্রের সন্ধান করতে হবে। চলো আগামীকাল গণিত শিক্ষকের সাথে বিষয়টি আলোচনা করি এবং দেখি নতুন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় কিনা।
পরের দিন গণিত শিক্ষককে অভি জিজ্ঞাসা করল, স্যার, আমরা গাছে না উঠেও কি গাছের উচ্চতা মাপতে পারি? তখন শিক্ষক বললেন, তোমরা ত্রিকোণমিতির কয়েকটি ক্লাস মনোযোগ দিয়ে করো, তাহলেই পরবর্তীতে তোমাদের সমস্যাটি সমাধান করতে পারবে।
পরিমাপের ক্ষেত্রে সমকোণী ত্রিভুজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমকোণী ত্রিভুজের তিনটি বাহুর মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্ক তোমরা পূর্বের শ্রেণিতে খুঁজে পেয়েছিলে। আর তা হলো, অতিভুজের উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্র অপর দুই বাহুর উপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান। সম্পর্কটি তৈরি হয়েছিল শুধু বাহুর মাধ্যমে। কিন্তু সমকোণী ত্রিভুজের তিনটি বাহু এবং তিনটি কোণ রয়েছে। বাহু এবং কোণ ব্যবহার করেও বিভিন্ন সম্পর্ক তৈরি করা যায় এবং সেটি বাস্তব জীবনে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। ত্রিভুজের কোণ এবং বাহুর অনুপাত ব্যবহার করে প্রাচীনকালেও মানুষ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেছে। যেমন, গাছে না উঠেও কীভাবে গাছের উচ্চতা মাপা যায়, নদীর এক তীরে দাঁড়িয়ে কীভাবে নদীর প্রন্থ মাপা যায় ইত্যাদি। এসব গাণিতিক কৌশলের উপর ভিত্তি করে ত্রিকোণমিতি (Trigonometry) নামে সৃষ্টি হয়েছে গণিতের এক বিশেষ শাখা। আর Trigonometry শব্দটি গ্রিক শব্দ tri (অর্থ তিন), gon (অর্থ ধার) ও metron (অর্থ পরিমাপ) দ্বারা গঠিত। মিশরীয় ভূমি জরিপ ও প্রকৌশল কাজে ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করত বলে ধারণা করা হয়। ত্রিভুজ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানসহ গণিতের বিভিন্ন শাখায় ত্রিকোণমিতির ব্যবহার রয়েছে।
একক কাজ
নিচের চিত্রগুলো থেকে এবং θ কোণের সাপেক্ষে অতিভুজ, বিপরীত বাহু এবং সন্নিহিত বাহু চিহ্নিত করো।
জোড়ায় কাজ
প্রত্যেকে খাতায় একটি সমকোণী ত্রিভুজ আঁকো যার বাহু তিনটির দৈর্ঘ্য তোমার ইচ্ছেমতো নিতে পার, কিন্তু ভূমি সংলগ্ন সুক্ষ্মকোণটি হতে হবে 30°. ত্রিভুজটি আঁকা হয়ে গেলে রুলার/স্কেল দিয়ে এদের বাহুগুলোর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করো এবং নিচের ছকটি পূরণ করো।
৪ নং থেকে ৯ নং ঘরের অনুপাত ৬টি তোমার অন্যান্য সহপাঠীর সাথে মিলিয়ে দেখো যে এগুলো মিলে গেছে নাকি পৃথক হয়েছে। অবশ্যই মিলে গেছে। উপরের কাজ থেকে তোমরা কিছু লক্ষ করলে কি?
তোমরা সবাই একটি সমকোণী ত্রিভুজের 30° সূক্ষ্মকোণের সাপেক্ষে বাহুগুলোর অনুপাত বের করেছ এবং বাহুগুলোর পরিমাপ বিভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও অনুপাত একই হয়েছে।
একইভাবে তোমরা যদি একটি সমকোণী ত্রিভুজের যে কোনো সূক্ষ্মকোণের সাপেক্ষে বাহুগুলোর অনুপাত বের করো, তাহলে দেখতে পাবে বাহুগুলোর পরিমাপ বিভিন্ন হওয়া সত্তেও অনুপাত একই হয়েছে। এই পরীক্ষণ থেকে আমরা বলতে পারি,
যে কোনো আকারের সমকোণী ত্রিভুজের সন্নিহিত বাহু ও অতিভুজের অন্তর্বর্তী কোণের মান একই হলে ওই সকল সমকোণী ত্রিভুজের বাহুগুলোর অনুপাত পারস্পরিকভাবে সমান হয়। কিন্তু সন্নিহিত বাহু ও অভিভুজের অন্তর্বর্তী কোণের মান ভিন্ন হলে অনুপাত ভিন্ন হয়।
সমকোণী ত্রিভুজের একটি নির্দিষ্ট সূক্ষ্মকোণের সাপেক্ষে বাহুগুলোর অনুপাত সবসময় একই হয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট কোণের জন্য বাহুগুলোকে ব্যবহার করে যত রকমের অনুপাত তৈরি করা যায় তা আমরা প্রথমে বের করে নিই। এক্ষেত্রে আমাদের আছে তিনটি বাহু: বিপরীত বাহু, সন্নিহিত বাহু ও অতিভুজ। তিনটি বাহুর যে কোনো দুটিকে ব্যবহার করে কতগুলো অনুপাত তৈরি করা যায়, তা কি তোমরা জানো? একটু চিন্তা করে দেখো, ছয়টি অনুপাত তৈরি করা যাবে। এই ছয়টি অনুপাত নিম্নরূপ।
জোড়ায় কাজ
পিথাগোরাসের উপপাদ্যের সাহায্যে আমরা পাই,
জোড়ায় কাজ
নিচের ছকে প্রদত্ত ত্রিকোণমিতিক অনুপাতের মান নির্ণয় করো। একটি করে দেয়া আছে।
জোড়ায় কাজ
একক কাজ
sin 0° এবং cos 0° এর মান ব্যবহার করে tan 0°, cot 0°, sec 0° এবং csc 0° এর মান বের করো।
আবার, ∆ABC এ ∆A কোণের মান ক্রমশ বড়ো হতে থাকলে AB এর দৈর্ঘ্য ক্রমশ ছোটো হতে থাকবে।
একক কাজ
উপরের সারণি ব্যবহার করে আমরা অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারি।
দলগত কাজ
উপরের সমস্যাটির মতো একটি করে সমস্যা তৈরি করো এবং তোমার একজন সহপাঠীকে সমাধান করতে দাও। সকলের সমাধান শিক্ষককে দেখাও।
সমকোণী ত্রিভুজের নিয়ম ব্যবহার করে তোমরা কিছু নির্দিষ্ট কোণের সাপেক্ষে ত্রিকোণমিতিক অনুপাত নির্ণয় করেছ। যে কোনো কোণের সাপেক্ষে ত্রিকোণমিতিক কোণের অনুপাত নির্ণয় করা কঠিন। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের হাতের কাছে বর্তমানে বৈজ্ঞানিক ক্যালকুলেটর, কম্পিউটার বা অন্যান্য ডিভাইস রয়েছে যার মাধ্যমে আমরা যে কোনো কোণের সাপেক্ষে ত্রিকোণমিতিক অনুপাতের মান বের করতে পারি। ঐসব ক্ষেত্রে আমরা কোণের মানের জন্য যে অনুপাতটি প্রয়োজন হবে তা বৈজ্ঞানিক ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে বের করে নিতে পারবো। তোমাদের অনুশীলনের জন্য নিচের কোণগুলোর মান ক্যলকুলেটর ব্যবহার করে বের করো এবং সহপাঠীদের সাথে মিলিয়ে নাও।
জোড়ায় কাজ
1) শ্রেণি শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক ক্যালকুলেটর বা কম্পিউটার ব্যবহার করে 40°, 55°, 62°, 83° কোণের ত্রিকোণমিতিক অনুপাত নির্ণয় করো। শিক্ষকের নির্দেশমতো আরও কিছু কোণের মান নির্ণয় করো।
দলগত কাজ/প্রজেক্ট
শ্রেণির সকল শিক্ষার্থী কয়েকটি দলে বিভক্ত হবে। প্রত্যেক দল তাদের সুবিধামতো বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের একটি কাঠি বা সোজা গাছের ডাল নিবে এবং এর দৈর্ঘ্য মেপে নিবে। যখন সূর্য হেলানো অবস্থায় থাকে, তখন প্রত্যেক দল একটি গাছের পাশে যাবে। এরপর কাঠি/ডালটিকে উল্লম্বভাবে ভূমিতে স্থাপন করে এর ছায়ার দৈর্ঘ্য মেপে নিবে। একই সময়ে গাছের ছায়ার দৈর্ঘ্য মেপে নিবে।
এবার উপরের ছবির মতো খাতায় △ABC আঁকো যেন AC এবং AB এর অনুপাত তোমাদের কাঠির দৈর্ঘ্য এবং কাঠির ছায়ার দৈর্ঘ্য-এর অনুপাতের সমান হয়। অর্থাৎ
আবার, Q বিন্দুটি ভূ-সমান্তরাল AB রেখার নিচের দিকে অবস্থিত। সুতরাং AB রেখার বিন্দুর সাপেক্ষে Q বিন্দুর অবনতি কোণ ∠QOB ।
গণিত শিক্ষক এবার সকল শিক্ষার্থীকে বললেন যে এতক্ষণে তোমরা বুঝে গিয়েছ ত্রিকোণমিতিক জ্ঞান আমাদের কত কাজে লাগে। কোণ পরিমাপের মাধ্যমে কোনো বস্তুর অবস্থানে না গিয়েও দুরত্ব মাপা যায়। গণিতবিদদের এই আবিষ্কার ছিল একটি বিপ্লব। তাই আমরা এখানে ত্রিকোণমিতির জ্ঞান অর্জনে মনোযোগী হবো। আমরা এই জ্ঞানের মাধ্যমে অনেক কঠিন সমস্যারও সমাধান করতে পারি।
এ পর্যন্ত যা শিখলাম, চলো সেগুলো ব্যবহার করে আমরা কয়েকটি বাস্তব সমস্যার সমাধান করি।
সমস্যা-১: একটি মই একটি ঘরের ছাদের কিনারে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে। মইটি দৈর্ঘ্য 12 ফুট এবং মইটি ভূমির সাথে 45° কোণ উৎপন্ন করেছে। ভূমি থেকে ছাদের উচ্চতা নির্ণয় করো।
সমাধান: ধরি, AC মইটির শীর্ষবিন্দু C এবং C বিন্দুটি ছাদের কিনারে রয়েছে। সুতরাং C বিন্দু থেকে ভূমির উপর লম্ব দূরত্বই হবে ছাদের উচ্চতা। চিত্রানুযায়ী BC = h (ধরি), ছাদের উচ্চতা এবং AC মইটির ভূমি AB এর সাথে 45° কোণ উৎপন্ন করেছে। তাহলে, ∠CAB = 45°. সমকোণী ত্রিভুজ ∆ABC হতে পাই,
সুতরাং দেয়ালটির উচ্চতা 8.49 ফুট (প্রায়)
সমাধান: ধরি, প্রথম বন্ধুর অবস্থান A, দ্বিতীয় বন্ধুর অবস্থান B এবং প্লেনের অবস্থান P. ধরি, P থেকে ভূ- সমতলের উপরে লম্বরেখা PQ = h এবং AQ = x.
সমস্যা-৩
একটি খুঁটি এমনভাবে ভেঙে গেল যে তার অবিচ্ছিন্ন ভাঙ্গা অংশটি খুঁটির গোড়া থেকে 10 মিটার দূরে মাটি স্পর্শ করে। মাটিতে খুঁটিটির স্পর্শ বিন্দুর অবনতি কোণ 30° হলে, সম্পূর্ণ খুঁটিটির দৈর্ঘ্য কত?
সমাধান:
জোড়ায় কাজ
প্রজেক্ট (দলগত কাজ)
শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তোমরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে ত্রিকোণমিতিক অনুপাতের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তোমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা বা মাঠ থেকে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ স্থাপনার উচ্চতা নির্ণয় করো। তোমরা উচ্চতা কীভাবে নির্ণয় করলে তা ছবিসহ একটি পোস্টার পেপারে উপস্থাপন করো।
common.read_more